জিহ্ববার টেষ্ট
এই উপমহাদেশের মানুষজনের জিহ্ববার টেষ্ট বাডের সাথে দুনিয়ার আর কোন দেশের মানুষের টেষ্ট বাডের মিল নাই। খুব সম্ভবত, সঙ্গত কারণেই ২ শতাব্দি ধরে আমাদেরকে শোষন ও শাসন করার ফলে এই ফ্যাক্টটা সবার আগে ধরতে পারে ব্রিটিশ মার্কেটাররা!
১) শুরুতেই চায়ের কথা বলি। চা হচ্ছে পৃথিবীর ২য় সর্বাধিক জনপ্রিয় পানীয়, প্রথমটা পানি। প্রতিদিন প্রায় ৩০০ কোটি কাপ চা সারা পৃথিবীতে খাওয়া হয়। তুরস্কের মিষ্টি “রেজা চা”থেকে শুরু করে তিব্বতের নোনা স্বাদ যুক্ত মাখন চা – প্রস্তুত প্রণালীর উপর ভিত্তি করে দুনিয়াতে প্রায় শ খানেক রকমের চা আছে তবে প্রধান প্রকারভেদের উপর ভিত্তি করলে চা মাত্র ৬ প্রকার!
যা হোক, চায়ের ইতিহাস লিখতে বসিনি এখানে, তবে এ ইতিহাস লম্বা এবং জটিল, এবং অত্যন্ত ইন্টারেস্টিং! বিশেষ করে, চায়ের পাতা নিয়ে ইংরেজরা কি ভয়াবহ রাজনীতি ও দুর্নীতি করেছিলো চৈনিকদের সাথে, সেটা নিয়ে বিশদ একটা লেখা তৈরী আছে আমার কাছে। যথা সময়ে তা প্রকাশ করা হবে। তো আমার সেই লেখাটা থেকে কিয়দংশ কোট করছিঃ
সারা দুনিয়ার আমরাই প্রথম দুধ-চা খাওয়ার প্রচলন করেছিলাম। বৃটিশরা আমাদের দুধপ্রীতির কারণে চায়ের সাথে দুধ মিশিয়ে চা বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছিলো। অথচ সে সময় বাকী দুনিয়া শুধু রং-চা বা লেবু-চা খেতো, কারণ চা কে তখনকার দুনিয়ার মানুষজন রীতিমতো পথ্য হিসেবে খেতো, মানে আমরা যেমন এখন চা কে রিফ্রেশিং ন্যাচারাল ড্রিংক হিসেবে খাই, সে সময় তেমনটা ছিলো না।
বৃটিশরা মিষ্টি জাতীয় খাবার পছন্দ করতো তাই তারা চায়ে চিনি মিশিয়ে খেতে শুরু করলো, আর তাদের সেই চিনির যোগান দিতে তাদের আরেক কলোনী আফ্রিকাতে শুরু হলো আখের চাষ! অর্থাৎ, এর আগে চায়ে চিনিও খাওয়া হতো না। স্রেফ গরম পানি আর লিকার! চা রেডি!
বিট্রিশরা ভারতবর্ষ দখল করে চায়ের মাস প্রডাকশন শুরু করলো, কোটি কোটি টন চা উৎপাদন হতে লাগলো, কিন্তু এত চা খাবে কে? ইউরোপে চা রপ্তানি করেও প্রচুর চা বেচে যেতো। বৃটিশরা চিন্তা করলো, ভারতীয়দের কাছেই যদি চা বিক্রি করা যায়, তাহলে চায়ের এই বাড়তি প্রডাকশনের খরচ তুলেও বেশ লাভ পকেটে ঢুকবে। কিন্তু ভারতীয়রা এই ভিনদেশী পানীয়র সাথে পরিচিত ছিলো না। আর জোর করে তো এই জিনিস কাউকে খাওয়ানোও যায় না। তাইলে এখন উপায়? উপায় হলো, আপাততঃ ফ্রি তে দিয়ে দাও।
বৃটিশরা প্রথম ভারতীয় উপমহাদেশের লোকজনদের ফ্রি চা খাওয়াতো, যাতে করে তারা এক সময় চা’য়ে এতটাই অভ্যস্ত হয়ে পড়ে যেন তা কিনে খায়। কিন্তু তারা দেখলো, ভারতবর্ষবাসী চা কে প্রত্যাখান করছে। খোজঁ নিয়ে তারা জানতে পারলো, ভারতীয়রা সবকিছুতে দুধ খুব পছন্দ করে। অপরদিকে বৃটিশদের চা ছিলো আদতে রং চা! তারা এও জানতে পারলো, ভারতীয়দের কাছে পানীয় হিসেবে দুধ খুবই জনপ্রিয় খাবার।
সুতরাং, বৃটিশরা বুদ্ধি বের করলো, চায়ের সাথে দুধ মিশিয়ে দিলে হয়তো ভারতীয়রা চা খাবে। যেই ভাবা সেই কাজ। বৃটিশরা তাদের চায়ের সাথে দুধ মিশিয়ে খাওয়ানো শুরু করলো ভারতীয়দের। এবং বলাই বাহুল্য, বৃটিশদের এই বুদ্ধি পুরোপুরি কাজে লেগেছিলো। আমরা আজ দুধ-চা খেয়েই বেশী অভ্যস্ত। আমরা ভারতীয় উপমহাদেশের লোকেরা দুধ বা দুধজাতীয় খাবার ভীষন পছন্দ করি, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। চায়ের সাথে যে দুধও মিশিয়ে খাওয়া যেতে পারে, এই তথ্য মনে হয় ভারতবাসীরা না থাকলে দুনিয়াবাসীরা আরো অনেক পরে জানতে পারতো।
২) পেপসি কোম্পানি যখন 1985 সালে ভারতে তাদের ব্যবসা শুরু করলো, সেলস ছিলো অনেক কম। গ্রীষ্মপ্রধান একটা দেশে পেপসি চলছে না, তার উপর সে সময় বাজারে কোকও ছিলো না! সুতরাং, পেপসি কোম্পানি অনেক চিন্তা করেও বিক্রি কম হবার কারণ খুঁজে পেলো না। শেষে তারা বাধ্য হয়ে ফুল স্কেল মার্কেট রিসার্চে নামলো। গবেষণার প্রতিবেদনে বলা হলো, পেপসিতে চিনির পরিমান কম, তাই ভারতের লোকজন একে ঠিক পছন্দ করছে না। তো এরপর পেপসিতে চিনি বাড়িয়ে দিয়ে ভারতের বাজারে বিক্রি করা শুরু করলো এবং পেপসির বিক্রি হু হু করে বিক্রি বাড়তে লাগলো।
আমার এক অষ্ট্রেলিয়ান কলিগ বলেছিলো, ’তোমাদের ডেজার্টে চিনি এত কড়া কেন?’ যে কেউ ওদের ডেজার্ট ও আমাদের মিষ্টি-সেমাই-পায়েসের চিনির পরিমানটা একটু পরখ করে দেইখেন, আকাশ পাতাল পার্থক্য পাবেন। আমি উত্তর দিলাম -”কারণ আমাদের কারিগুলোর ঝালটাও কড়া কিনা, সেটাকে সামাল দিতে একটু কড়া চিনি আমাদের খেতে হয় বৈকি!”
৩) আমি শুধু এই দেশেই দেখেছি, পপকর্ণ আর লেমোনেডের সাথে বিট লবন মিশিয়ে বিক্রি হতে। দুনিয়ার আর কোথাও এই দুই খাবারে লবন দেয়া হয় না।
এটার কারণ এই হতে পারে যে, উন্নত বিশ্বে পপকর্ণের সাথে সাধারনত দেয়া হয় মাখন, মাখন গলে গরম পপকর্ণের সাথে মিশে যায় বলে খেতে খুবই মজাদার লাগে। আমার ধারনা, এই দেশে মাখন ব্যয়বহুল আর আপাতঃ দুর্লভ, তাই এর সহজ বিকল্প হিসেবে সস্তা ও সুলভ লবনকে ব্যবহার করা হয়।
আর লেমোনেডের সাথে বিট লবন দেয়া হয় কারণ আমরা বিশ্বে প্রথম ওরাল স্যালাইনের আবিস্কারক, এবং তরল স্যালাইনের অন্যতম মূল উপাদান হচ্ছে লবন। যে কোন তরলে আরোপিত লবন খেয়ে আমরা জাতিগতভাবে অভ্যস্ত। শুধু তরলে না, শসা, গাজর, ডিম এসেবও। কারণ জাতিগত আমরা এও বিশ্বাস করি, হজমের জন্য লবন সহায়ক।
আপনি কি আর কোন অমিল খুঁজে পেয়েছেন, যেটার সাথে বাকী দুনিয়ার মিল নেই, যেটা আমাদের দেশ বা উপমহাদেশের একান্তই নিজস্ব?
কার্টেসি- Proloy Hasan
No comments